Subscribe Us

মুক্তি (রামমনি হালদার)

লেখাটি বার পড়া হয়েছে


✍️রামমনি হালদার


মুক্তি

সেদিন টিয়া কারো বারণ শোনে নি। কি করেই বা শুনতো?নিজের ডানার উপরে ভর করে প্রথম ওড়ার আনন্দ টুকুকে কি কোনো বারণ আটকাতে পারে? অনভিজ্ঞ টিয়াও সেদিন মায়ের শাসনের, বারণের , উপদেশ এর কারাগার থেকে মুক্তির আশায় সবকিছু কে তুচ্ছ করে উড়ে চলেছিল অনন্ত মুক্তির খোঁজে। আর যাই হোক বন্ধন থেকে মুক্তি চায় সে। শাসন থেকে মুক্তি চায় ।  ডানার ক্ষমতার অহংকারের পিছনে সেদিন বাস্তব অভিজ্ঞতায় সম্পৃক্ত মায়ের বারণ, উপদেশ গুলো যেন হাতকড়া নিয়ে পিছনে ছুটছিলো। সেও সর্বশক্তি নিয়ে মুক্তির নেশায় ছুটে চলেছিল নাগালের বাইরে।কোন ভাবেই সে আর ধরা দেবে না। মুক্তির এমনই নেশা হলো তার।

 নেশার ঘোর কাটলো তখন যখন তার হৃদযন্ত্র লক্ষ্য করে ছুটে আসা শিকারির তির খানা গুরুতর ভাবে জখম করল তাকে। তবে সে যাত্রায় কপাল জোরে সময় থাকতে সামান্য বেঁচে থাকা জীবনীশক্তি টুকু দিয়ে শিকারির নাগালের বাইরে যেতে পারলো। কিন্তু নাগালের বাইরে গিয়েই জ্ঞান হারিয়ে, ক্ষমতা হারিয়ে মাটিতে পতিত হলো তার ক্ষত বিক্ষত আধমরা শরীরটি। কিছুক্ষণ ছটফট করে শক্তির ভাঁড়ার রিক্ত হলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়লো।পিতা মাতার শাসন, বারণ, আদেশ, উপদেশ বর্মের মতো কি ভাবে কঠোর পৃথিবীর বাস্তব আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখে এতক্ষনে তা সে খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে । ওড়ার অহংকার মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেন বিদ্ধ করতে লাগলো তার অন্তরাত্মাকে।কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে অনেক দূরে চলে এসেছে সে। ভুল স্বীকার এর শুভবুদ্ধির উদয় হলেও করুনাময়ী মা তার কাছে নেই।এই সমস্ত ভেবে আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় সময় গুনতে থাকল। তখন শারীরিক ক্ষতের যন্ত্রনাকে হৃদয় যন্ত্রনা ছাপিয়ে গেল। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, মনে উদয় হতে লাগলো কি করে মা ঝড় বাদলের সমস্ত আঘাত নিজে সহ্য করে তাকে আগলে রাখতো ডানার নিচে। কি করে নিজে আধ পেটা থেকে খাবার টুকু এনে তুলে দিত তার মুখে। কিন্তু সেই মাকেই সে আজ ছেড়ে এসেছে মুক্তির লোভে, স্বাধীনতার লোভে। মুক্তিতে  আছে নেশার ঘোর যা ক্ষণিকের আনন্দ দেয় ঠিক ই কিন্তু আত্মীয়তার বন্ধন যে সর্বাঙ্গীন সুখের চাবিকাঠি সেই পরম সত্য নিঃসঙ্গ বাস্তবের সম্মুখীন না হলে উপলদ্ধি হয় না। 
 
তার জ্ঞান চক্ষুর উদয় হলে পার্থিব চোখ বুজে এলো।তবে প্রাণ বায়ু টুকু সন্ধ্যা প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগ মুহূর্তে যে ভাবে সলতের আগায় এই নেভে এই নেভে করে টিম টিম করে জ্বলে সেই ভাবে রইলো। বাহ্যিক জগতের সমস্ত শব্দ যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে নিজের হৃদযন্ত্রের ধুক্ ধুক্ আওয়াজ টুকুই জীবন মৃত্যুর এই যুদ্ধে তার কানে রণ-ডঙ্কা হয়ে বাজতে লাগলো। 

পাশেই এক রাখাল গরু চড়াচ্ছিল।খুব ছোট বেলায় বাপ মা হারানো রাখালের আত্মীয় স্বজন বলতে ছিল ওই অবলা প্রাণী গুলোই। স্বভাবতই অবলা জীবেদের প্রতি তার সাধারণের থেকে অন্যরকমের মমত্ব বোধ ছিল। সহজ সরল গ্রাম্য বালক টির চোখ পড়লো ক্ষত-বিক্ষত  টিয়ার দিকে। মৃত্যু পথযাত্রী রক্তাক্ত প্রাণীটিকে দেখে কোমল হৃদয়  রাখালের চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল টিয়ার শরীরে পড়তেই সে চোখ মেলে তাকালো । 
 টিয়ার দেহের সমস্ত ক্ষত যেন দ্বিগুন হয়ে ঘা দিলো রাখালের বুকে।সমব্যথী রাখাল সন্তর্পণে টিয়াকে অঞ্জলিপুটে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। দিন-রাত এক করে সেবা শুশ্রূষা করতে লাগলো তার।কখনো হলুদ লাগিয়ে দিত  ক্ষত স্থানে, কখনো বা ঔষধি গাছড়া। কখনো আবার সাত আট ক্রোশ হেটে গেছে পশু চিকিৎসক এর কাছে।  টিয়ার ব্যথা যেন শুধু টিয়ার একার নয়, তার ও। এক মুহূর্তের জন্য সে তাঁকে চোখের আড়াল করতো না।

 বসন্তে সব পাতা ঝরে বর্ষার আগমনে নিঃস্ব বৃক্ষ যেমন আবার নবযৌবন লাভ করে সবুজ হয়ে ওঠে, ধীরে ধীরে টিয়ার শরীরেও ক্ষত স্থান সেরে গিয়ে সবুজ সবুজ পালক গজিয়ে উঠতে লাগলো। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া টিয়ার ঠোঁট যেন আবার আলতা রঙে লাল হয়ে এলো ।
 অন্যদিকে গ্রীষ্মের প্রখর রোদে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠ যেমন বর্ষার জল পেয়ে ক্ষত স্থান সারিয়ে নেয় তেমনই টিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি যেন আনন্দাশ্রু হয়ে রাখালের হৃদয়ের ক্ষত সারিয়ে দিলো। দীর্ঘদিন রোজার শেষে ঈদের চাঁদের মুচকি হাসি যেমন চারিদিকে খুশি ছড়িয়ে দেয় তেমনই রাখালের মুখেও ফুটে উঠলো সেই খুশির হাসি। জীবন যেন টিয়া নয়, সে ফিরে পেয়েছে।

এতদিনে মুক্তির নেশা কেটে গিয়েছে তার, আত্মার বন্ধন যে কতো মধুর তা তো সে আগেই উপলব্ধি করেছে। এই নির্দয় স্বার্থান্বেষী পৃথিবীতে রাখালের মতো নিঃস্বার্থ প্রাণের সেবা যেন পরশ পাথর হয়ে তার স্বার্থের হৃদয়টিকে করুনার আশ্রম করে তুললো। রাখালের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ প্রকাশ করলে যে আসলে রাখলকে অপমান ই করা হবে একথা স্মরণে রেখে  সে ধীরে ধীরে তার  কাছে এলো। রাখাল তাকে অঞ্জলিপুটে নিয়ে  মুখের সামনে এনে এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর টিয়া চোখের দৃষ্টি নামিয়ে রাখালের প্রতি যেন সমর্পণ প্রকট করলো।

ধীরে ধীরে রাখালের ভালোবাসা, আদর , সেবা , তার পূর্বের বন্ধন ছেঁড়ার স্মৃতি ঘুচিয়ে তাকে নব বন্ধনে আবদ্ধ করলো। মন্দিরের গর্ভগৃহে অধিষ্ঠিত দেবতার মতো এই বন্ধনকেও সে পরমানন্দে হৃদয় মন্দিরে স্থাপন করলো।

ক্ষত সারিয়ে এবার টিয়া অল্প অল্প উড়তে পারছে। রাখাল হাতে করে তাকে উড়িয়ে দিত, কিছুটা ওড়ার পর যখন আর শরীর সায় দিত না তখন রাখাল তাকে পরম যত্নে লুফে নিত। এই ভাবে বেশ কিছুদিন কাটার পরে এবার টিয়া ঠিক ঠাক উড়তে শিখলো। রাখাল তাকে নিয়ে উড়িয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে সে আবার উড়ে তার কাছে চলে আসে। ধীরে ধীরে বন্ধনের গাঢ়ত্ব বাড়তে শুরু করেছে। এখন চলছে কথা শেখার পালা। টিয়া নিজেও জানতো না যে তার ভিতরে এত সুন্দর কথা বলতে পারার ক্ষমতা সুপ্ত ছিল, এত সুন্দর গান গাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তার এই গুণ উন্মোচন এর কৃতিত্ব যেন শুধুই রাখালের। 

রাখাল যতক্ষণ বাড়িতে থাকতো ততক্ষণ সব সময় টিয়া তার পাশে পাশেই থাকতো। 
সদ্য ফোটা বুলিতে সে রাখলকে শোনালো তার মায়ের গল্প, কি করে মুক্তির লোভে তার ওই দশা হয়েছিলো। সবটা শুনে রাখাল বললো, 
" তুমি তো এখন সুস্থ, ঘরে ফেরার সময় এসেছে এখন"। একথা শুনে টিয়ার চোখ ছল ছল করে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে , ডানা ঝাপটে , সর্বপ্রকারের অঙ্গ ভঙ্গি করে সে রাখালের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করতে লাগলো। রাখাল ও টিয়ার কষ্ট দেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললো " নাঃ তোমাকে কোত্থাও যেতে হবে না, আমার বাড়িতেই তুমি থাকবে, আমার পাশেই থাকবে ।" একথা শুনে টিযা উড়ে গিয়ে রাখালের ঘাড়ে বসে তার গালে ঠোঁট ঠুকরে আদর করতে লাগলো।

 রাখাল একটা মাটির হাঁড়ি ফুটো করে তাতে বিচালি, নারিকেল এর ছোবড়া ইত্যাদি দিয়ে তার থাকার জায়গা করে দিলো। রাখাল যখন মাঠে যেত টিয়া তখন সেই হাঁড়ির ভিতরে থাকত। ফিরে এসে টিয়ার সাথে জমিয়ে গল্প করতো। সুখ দুঃখের কথা কইত। টিয়া সে কথা কতক বুঝত কতক বুঝতো না। তবে সব কিছুতেই এমন ভাবে অঙ্গ ভঙ্গি করতো যেন সে সব বুঝতে পারে। এই ভাবে টিয়ার সাথে আত্মীয়তা যেন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠলো। টিয়া সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে কখন রাখাল বাড়ি ফিরে তাকে ডাকবে। 

এই ভাবে বেশ কিছুদিন কাটলো, এখন রাখাল বাইরে গেলে টিয়া ঘরের বাইরে ওই গাব গাছে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রোজ তার সমগোত্রীয় পাখিদের উড়ে যেতে দেখে তার মন কেমন করতো। সে না ছিলো খাঁচায় বন্দি, না ছিল পায়ে বেড়ি তবুও কিসের একটা টান যেন তাকে উড়ে যেতে বাঁধা দিচ্ছিল।

 অসাধারণ জিনিস ও যেমন প্রাচুর্যের ফলে প্রথমে সাধারণ পরবর্তীতে এক ঘেয়ে হয়ে যায়,
 রাখালের যত্ন ও যেন এখন তার কাছে একঘেয়েমী মনে হতে লাগলো। প্রথম দিকে যা তাকে সুখের আভাস দিত তা যেন এখন বিরক্তিকর লাগে। কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে সেসব যদিও রাখলকে সে বলতে পারে না কিন্তু রাখাল তাকে এখন হাতে নিতে চাইলে সে উড়ে গিয়ে দূরে বসে। এখন আর তার ঘাড়ে বসে গালে ঠোকর দিয়ে আদর করে না । দীর্ঘদিন রাখালের যে যত্ন বন্ধনের গাঢ়ত্ব সম্পৃক্ত করেছিল ,যত দিন যেতে লাগলো সেই যত্ন অতিপৃক্ত হয়ে থিতিয়ে পড়তে লাগলো। রাখালের সামনে সে কোনোরূপ বিরক্তির প্রকাশ না করলেও রাখাল কাছে গেলে সে ছটফট করতো। যে ছটফটানি আগে ছিল রাখাল এর ফিরে আসার অপেক্ষায় , তা ছিলো সুখের। কিন্তু এখন যে ছটফটানি তা মোটেই সুখের নয় বরং চাপা কষ্টের।

একদিন ওই গাব গাছে আর একটি তোতা এসে বসলো। টিয়া কে দেখে কাছে গিয়ে তার খোঁজ খবর নিলো। টিয়াও তার কাছে শুনলো বাইরের জগতের খবর। তোতার ভালো-মন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি।  এখন রোজ তোতা ফেরার পথে টিয়ার সাথে ভালো মন্দ গল্প করে যায়। কোথায় লঙ্কার ক্ষেত, কোথায় ফলের বাগান ইত্যাদি সব খবর তোতা এসে টিয়া কে দেয়। রাখালের কথা শুনে যেমন মন রাখার জন্য না বুঝেও বোঝার ভান করতে হত, তোতার কথা শুনে সেই অভিনয় করতে হয় না। এ যেন তার প্রাণের কথা, মনের কথা, আত্মার কথা। এখন আর সে রাখালের অপেক্ষা করে না, অপেক্ষা করে তোতার আসার। রাখাল এলে সে আর উড়ে তার কাছে যায় না। এখন যেন বসে থাকে কখন রাখাল তার সামনে থেকে সরে যায় সেই অপেক্ষায়। কিন্তু সে কথা কখনোই মুখে বলে না। কিন্তু টিয়ার মুখে বিরক্তির ভাব দেখে রাখাল বেশ বুঝতে পারে। তাই এখন রাখাল ও খাবার দেওয়া বা বাসা পরিষ্কার করা ছাড়া কোনো সময় ই টিয়ার কাছে যায় না। এমন করে ধীরে ধীরে তাদের বন্ধন আলগা হতে লাগলো আর উল্টো দিকে তোতার সাথে টিয়ার বন্ধন দৃঢ় হতে লাগলো। 
বিধাতা এমন করে যোগ বিয়োগের সমতা বিধান করে রেখেছে যেখানে কোনো এক জায়গায় যোগ হলে অন্যখানে বিয়োগ হতে বাধ্য।

একদিন টিয়া তোতার গল্পের আসরে মুক্তির প্রসঙ্গ উঠে এলো। তোতা তার যুক্তি এমন ভাবে উপস্থাপন করল যে টিয়ার বন্ধনের যুক্তি সেখানে আর খাটলো না। তোতা যাবার কালে বলে গেল বন্ধন তখন ই ভালো যখন তা স্বজাতীয় দের সাথে হয় বিজাতীয়দের সাথে নয়।

সেদিন সারা রাত সে তোতার সেই শেষের কথাটি ভাবতে লাগলো। মনের মধ্যে নানা ধরণের প্রশ্নের উদয় হলো।
 রাখাল কে?
রাখালের জাতি ই বা কী?
তার সাথে রাখালের কিসের আত্মীয়তা? 
যদি বন্ধনেই বাধার হতো তবে বিধাতা তাঁকে ডানা ই বা দিলো কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেই বিনিদ্র রাত তার জীবনের অতীতের দ্বার চিরতরে বন্ধ করে যেন খুলে দিলো ভবিষ্যতের মুক্তির দুয়ার। 

রাত পোহালে ভোরের কাক যখন ডেকে উঠলো ।সেদিন টিয়া ঘরের চালে গিয়ে বসল। সে দেখলো তার মতো কত পাখি মুক্তির আনন্দে উড়ে যাচ্ছে । মনে মনে ভাবলো কই তারা তো কোনো বন্ধনে আবদ্ধ নেই। তবে সে কেন রাখালের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে ? কিসের সেই বাধঁন? কেনই বা সে সেই বাধঁন ছেড়ে উড়ে যেতে পারবে না।

সূর্যোদয় হলে রাখাল গরু গুলো গোয়াল থেকে বের করে তাঁদের খেতে দিয়ে টিয়ার বাসার কাছে গিয়ে দেখলো গতকাল সে কিছুই খায় নি। সে টিয়া কে বাসায় দেখতে না পেয়ে উঠোনে যেতেই দেখলো সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘরের চালের উপরে বসে আছে। রাখাল কে দেখে সে নিচে নেমে এলো। 
গতকাল না খাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করায় টিয়া উদাসীন হয়ে বললো " ও কিছু না" ।
রাখাল বললো, " ও আবার কি কথা, না খেলে শরীর খারাপ করবে যে।"
টিয়া বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেই বললো, " শরীর খারাপ হলে হোক গে"
 একথা শুনে রাখাল তাকে আর বেশি কিছু না বলে শুধু খেয়ে নেওয়ার কথা বলে রোজকার মতো গরুর পাল নিয়ে মাঠে চলে গেল, আর টিয়া আবার সেই গাব গাছে গিয়ে বসলো। রোজকার মতো তোতা আবার এলো। টিয়ার মন উদাস দেখে তোতা তাঁকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় টিয়া কান্না চেপে রেখে ধরা গলায় বললো , " মনটা ভালো নেই।"
 একথা শুনে তোতা একটু মুচকি হাসি দিয়েই বললো," মনের আর কি দোষ বলো, সে তো ডানা মেলে দূর আকাশে উড়তে চায়, তাকে যদি অজানা বাঁধন দিয়ে বেঁধে রাখো ,সে তো ছটফট করবেই।"
 টিয়া এবার আবেগ বিহ্বল হয়ে , চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না।
 তোতা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো," মন যখন চাইছে না তাকে এবার মুক্ত করেই দাও।"
 টিয়া কাঁদো কাঁদো সুরেই বললো, "কিন্তু কি করে?"
 - কি করে মানে? আর সবাই যেমন করে  উড়ে যায় সেভাবেই।
 - কিন্তু আমি যে পারছি না, রাখাল আমায় নতুন জীবন দিয়েছে, সেবা শুশ্রূষা করে আমায় সুস্থ করেছে, আমায় ভালোবেসেছে, আমি তাকে ছেড়ে যাই কি ভাবে?
 - জীবন বাঁচিয়েছে বলে জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার ও কি তার? সুখ দিয়েছে বলে কি দুঃখ ও সে দিতে পারে?  না না সে অধিকার তার নেই। এ অধিকার কারো হতে পারে না। বিধাতাপুরুষ প্রাণীকূলকে সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়েছে  কিন্তু ধ্বংসের অধিকার দেয় নি। তাই তুমি নির্দ্বিধায় উড়ে গিয়ে নিজে বাঁচার মতো বাঁচতে পারো, সুখ খুঁজে নিতে পারো। এর থেকে কোনো বন্ধনই তোমায় বঞ্চিত রাখতে পারে না। চলো আমার সাথে উড়ে চল।
 
তোতার এই আহ্বান সে ফেরাতে পারলো না।
তাই তোতা আজ আর একা ফিরলো না, সাথী হল টিয়াও। সত্যি বলতে কি সময় কতনা শিক্ষা দিয়ে যায়, সময় বয়ে গেলে সে সবই মুছে যায়।
 
সন্ধ্যা হলে রাখাল ফিরে এসে টিয়ার বাসার কাছে গিয়ে দেখলো টিয়া আর সেখানে নেই। 
তার আর বুঝতে বাকি রইলো না। বিগত কয়েক দিনের টিয়ার স্বভাবের পরিবর্তন সে ভালো ভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছিলো । টিয়া তার আবেগে নয় মননে ছিলো তাই মুখ ফুটে টিয়া কিছু না বললেও তার মনের ব্যথা রাখাল ঠিক বুঝতে পেরেছিল। টিয়া যে কথা লজ্জায় কোনোদিন বলতে পারে নি, সে কথা যে সে বুঝতে পেরেছে সেটা বুঝিয়ে রাখাল তাঁকে লজ্জা দিতেও চায় নি।

একটা মুচকি হেসে রাখাল মনে মনে বললো--- " তোমার জন্মই  হয়েছে মুক্তির প্রতীক হিসেবে,স্বভাবে তোমার মুক্তির নেশা, তোমার জীবন যাত্রায় আমার মতো পথিক তোমায় বন্ধনে বাঁধার সাহস করে কি করে ?"

তখন গোধূলির আলতা রাঙা রং মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো , রাখালের দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা বয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বলে উঠলো, "যাবার বেলা অন্তত একবার বলে যেতে পারতে"


✍️ রামমনি হালদার
উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
অসাধারণ