Subscribe Us

রজনীগন্ধা (রামমনি হালদার)

লেখাটি বার পড়া হয়েছে

রজনী গন্ধা

কলমে-রামমনি হালদার


পাত্র পক্ষ শ্রীময়ী কে দেখে গিয়েছে। শ্রীময়ীর বাবা সুবীরেশ বাবু ঘটক মশাইয়ের সাথে কথা বলে শ্রীময়ীর মা কে ডেকে বললো "কই গো শুনছো, ঘটক বাবুর কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে ওদের আমাদের মেয়েকে  বেশ পছন্দ হয়েছে।"
কথা গুলো শ্রীময়ী আড়ি পেতে শুনছিলো।
শ্রীময়ীর ও পাত্র শুভম কে দেখে খুব পছন্দ। আর বাবার মুখে সুখবর টি  যেন শ্রীময়ীর মন কাননে হাজার বসন্ত  এক সাথে এসে বাহারি রঙের ফুল ফুটিয়ে দিয়ে গেল। 
যথারীতি নিয়মের তিন দিন পার হওয়ার পর শুভম এর  বাবা বিমল বাবু নিজে ফোন করে সুবীরেশ বাবুকে সুখবরটা দিলেন।

সন্ধ্যার সময় চা খেতে খেতে সুবীরেশ বাবু আদরের একমাত্র মেয়েকে কাছে ডেকে বললেন, " আয় মা আমার পাশে একটু বস, আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কত বড়ো হয়ে গেছে দেখি, আর কদিন পরে রাজপুত্র এসে এই রাজকন্যা কে নিয়ে যাবে---
হ্যাঁ রে মা তোর শুভম কে পছন্দ তো?"
শ্রীময়ীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
সে তার পোষা কুকুর টমি কে কোলে নিয়ে পাশের ঘরে যেতে যেতে বললো 
" তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।" 
সুবীরেশ বাবু চা খেতে খেতে বলতে লাগলো,
"আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ছেলে খুব ভদ্র, রথতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক, বাবা মায়ের এক ছেলে, কোনো বাজে নেশা নেই। আর কি চাই বলো শ্রীময়ীর মা?"
শ্রীময়ী পাশের ঘর থেকে মন দিয়ে কথা গুলো শুনছিলো। 
মনে মনে এখন থেকেই সে মনের মধ্যে শুভম কে আঁকতে লেগেছে। শ্রীময়ী এমনি তেই ভাবুক প্রকৃতির। তার উপরে বাবার কথা তার ভাবনার সাগরে যেন জোয়ার এনে দিলো। মনে মনে সে স্থির করলো তার বাসর ঘর নিজের হাতে লাগানো রজনীগন্ধা দিয়েই সাজবে ।

পরের দিন বান্ধবীরা এসে  খুনসুটি শুরু করে দিলো তাকে নিয়ে। ব্যাপারটা শ্রীময়ীর মনে মনে বেশ ভালোই লাগছিলো। তবে সে কথা তো আর বান্ধবীদের বুঝতে দেওয়া চলে না। তাই একটু রাগের ভান করেই বললো " তোরা কি এবার থামবি ,আমার এসব একদম ভালো লাগে না, দেখতে তো দেখলাম ক্যাবলা কান্ত।"
বান্ধবীরাও ছাড়ার পাত্রী নয়,  বলে উঠলো,
 "ওরে আমার ক্যাবলা কান্তি, মনে তো লাড্ডু ফুটছে , তবে অতো ভনিতা করার কি হলো বাব্বা,  তোমার ক্যাবলা কান্ত কে আমারা কেড়ে নেব না"
"উফ্ফ্ তোরা থামবি?" বলে হন হন করে পাশের ঘরে যেতে যেতে বললো " একটু দাঁড়া আমি চেঞ্জ করে আসি বাজারে যাবো।"
বান্ধবী- "কেন রে তর সইছে না নাকি, বিয়ের বাজার কি আজ ই শুরু করলি নাকি?"
শ্রীময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে - "তোদের মুন্ডু, চল্ এবার"

বাজারে গিয়ে বেশ কয়েকটি রজনীগন্ধার চারা এনে খুব যত্ন সহকারে তার ঘরের ধারের সখের  ফুল বাগানে সেগুলি লাগিয়ে দিলো। একদিন ঘরে এসে জানলার পাশে বসে ওই রজনীগন্ধার চারা গুলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে কেবল শুভম এর কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। এদিকে বাড়ির ফোন টা  বেজেই চলেছে সে যেন তা শুনতেই পেলো না। মা রান্না ঘর থেকে চিৎকার করতে করতে এসে তাকে ধাক্কা দিতেই সে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। 
মা- " ফোন টা যে কানের কাছে বেজে যাচ্ছে শুনতে পাচ্ছিস না নাকি? আমার হাতে এঁটো ফোন টা তোল । "ওহ্ হ্যা ফোন" বলে কানে ফোন টা নিয়ে "হ্যালো" বলতেই ওপার থেকে ভদ্র ও নম্র গলায় কথা ভেসে এলো "মেসোমশাই আছেন? আমি শুভম বলছি।" 
হঠাৎ যেন শ্রীময়ীর মনে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কিছুক্ষনের জন্য সে চুপ হয়ে গেল।
শুভম - "হ্যালো , হ্যালোওও , শুনতে পাচ্ছেন কি?"
শ্রীময়ী ফোন টা মার কানের কাছে নিয়ে অন্য কানে ফিস্ ফিসিয়ে বললো,
"ও ফোন করেছে"
মা-" তো শোন কি বলছে"
শ্রী: "উফ্ফ্ তুমি বলো না"
মা ফোন এ 
- বাবা ওর বাবা তো একটু বাইরে গেছেন।
- ও মাসিমা, প্রণাম নেবেন।
- বেঁচে থাকো বাবা।
- বলছি মেসোমশাই এলে বলবেন, বাবা বলেছে আপনাদের যদি কোনো অসুবিধা না থাকে তবে আগামী মাসে একটা ভালো দিন আছে ।ওই দিন আপনারা আসতে পারেন।
- আচ্ছা বাবা ।
- আচ্ছা রাখি তবে?
- আচ্ছা
শ্রীময়ী মাকে খুঁচিয়ে "কি বললো ?"
মা - পরের মাসে যাওয়ার কথা বললো।

শ্রীময়ী রোজ ফুল গাছে জল দিতে দিতে ভাবে ইস্.. ফুল গুলো যদি ঠিক সময়ে না ফোটে কি হবে ?? ধুর ওরা যা দেরী করছে এতে তো মনে হচ্ছে ফুল গুলো ততদিন থাকবেই না আর।
এই সব ভালো-মন্দ কথা ভাবতে ভাবতে অপেক্ষার প্রতিটি দিন যেন শ্রীময়ীর কাছে এক একটা বছর এর মতো মনে হতে লাগলো।

আবার ভাবতো ইস্ সেদিন তো ঠিক করে দেখতেই পেলাম না ,যদি আর একবার দেখতে পেতাম।
শ্রীময়ী দের বাড়ি থেকে যেদিন পাত্র পক্ষের বাড়িতে দেখতে যাবে, সেদিন পাশের বাড়ির বৌদিও যাবে শুনে বৌদি কে গিয়ে বললো 
"যদি পারো তো ওর একটা ছবি তুলে এন,"
বৌদি হেসে বললো "আচ্ছা ঠাকুরঝি আনবো।"

সেদিন শুভমরা আপ্যায়ন এর কোনও ত্রুটি রাখলো না । পাকা কথা দিয়ে এলেন সুবীরেশ বাবু। দিন তারিখ স্থির হলো অঘ্রায়ণ এর ১৪ তারিখ গোধূলী লগ্নে সন্ধ্যা সাত টায়।

বিয়ের এখনও মাস খানেক বাকি।
এখন লজ্জা পর্ব কাটিয়ে  প্রায় প্রতিদিন ই শুভম আর শ্রীময়ী এর মধ্যে কথা হয়। চলে একজন আর একজন কে চেনা জানার পর্ব। 
শ্রীময়ী তো আগেই বলেছি খুব ভাবুক প্রকৃতির, তবে খুব মন চাপা তাকে ধরা অতো সহজ নয়।
কিন্তু শুভম আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতই, বাস্তববাদী আদিখ্যেতা জিনিসটা তার ঠিক আসে না। যত দিন যেতে লাগলো শ্রীময়ীর মনে শুভম এর প্রতিচ্ছবি টা যেন আরো মূর্ত হতে লাগলো। মনে আঁকা ছবি টা দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক এখন। 
শুভমের প্রতি তার প্রেম , আবেগ এর বহ্নির সমস্ত টাই সে মনের গোপন বাক্সে লুকিয়ে রেখেছে। 
অন্যদের তার আঁচ অবধি লাগতে দেয় না। এমন কি শুভমের সাথে কথা বলার সময় ও খুব সংযত থাকে।  যখন একদম একাকী থাকে তখন সে ওই বহ্নি শিখা গুলোতে অগ্নিস্নান করে শুদ্ধ হয়।

আর সেই তার ফুল বাগানের পাশের জানলার শিক ধরে পাখিদের কলতান আর সদ্য কলি আসা রজনীগন্ধার গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে  প্রহর গুনে দিন কাটাতে থাকে। আর সারাদিন ফোনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে কখন ফোনের রিংটোন টা তার কানে আসবে।

দেখতে দেখতে আশীর্বাদের দিন এলো। দূরের আত্মীয়স্বজন দের অনেকেই বাড়িতে এসেছে। প্যান্ডেল ওয়ালা এসে বাড়িতে বাঁশ ফেলে গেছে। বাবা , মামা, ও পাড়ার কয়েক জন বয়োজ্যেষ্ঠ মিলে আশীর্বাদ করতে শুভম দের বাড়ির উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

শুভমদের পরিবার খুব ধর্মপ্রাণ। পুরোহিত মহাশয় গৃহদেবতার পূজো করে আশীর্বাদের আয়োজন করছেন। এদিকে বৈঠক খানায় বাড়ির সকলে মিলে শ্রীময়ীর বাড়ির লোকেদের সাথে বসে আলোচনা করছে। 
শুভম এর বাবা যে জ্যোতিষী কে আসতে বলে ছিলেন ,উনিও এসে বসলেন।
জ্যোতিষী কে দুজনের কুণ্ডলী দিয়ে সেটা বিচার করতে বললেন । জ্যোতিষী মন দিয়ে কুন্ডলী দেখছেন বাকিরা এদিকে গল্প করছেন।
এর মধ্যে শুভম এসে বয়োজ্যেষ্ঠ দের প্রনাম ও সৌজন্য বিনিময় করে নিজের ঘরে গেল।

কিছুক্ষন পরে জ্যোতিষী শুভম এর বাবা বিমল বাবুকে উদ্যেশ্য করে বললেন,
"বিয়ের দিন ক্ষণ কি ঠিক করে ফেলেছেন?"
উত্তর এলো ," হ্যাঁ, কেন কোনো খারাপ কিছু দেখলেন?"
এদিকে শ্রীময়ীর বাবার মুখ শুকিয়ে গেল।
উনিও বললেন ," কোনো খারাপ কিছু কি দেখলেন"
জ্যোতিষী ভারী গলায় বললেন...
" এদের কুন্ডলীর কোন কিছুই ভালো নয়, মেয়ে দেব গণ, ছেলে রাক্ষস গণ, উপরন্তু মেয়ে মাঙ্গলিক, এদের বিয়ে হলে একবছরের মধ্যে পাত্রের জীবনে ঘোর বিপদ আসবে এমনকি মৃত্যু অবধি হতে পারে।"
আনন্দ ঘন মুহূর্ত গুলো হঠাৎ যেন দুঃখের কালো মেঘে ছেয়ে গেল। শ্রীময়ীর বাবার চোখের কোন ভিজে গেল।
সবাই কিছুক্ষনের জন্য একদম নিশ্চুপ । হঠাৎ গ্রহণ লাগলে যেমন গোটা পৃথিবীতে অন্ধকার ছেয়ে যায় শুভম দের বাড়ির পরিস্থিতি টাও যেন তেমন হয়ে গেল। বিজ্ঞানের শিক্ষক শুভম ও কোনো কথা বললো না। জ্যোতিষী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
বিমল বাবু শ্রীময়ীর বাবার উদ্যেশ্যে বললো," সুবীরেশ বাবু , আমাকে দুটো দিন ভাবতে সময় দিন, আশীর্বাদ আজ হবে না। আপনারা দয়া করে খাওয়া দাওয়া সেরে যাবেন। অতিথি অন্ন গ্রহণ না করলে গৃহস্থের ঘোর অকল্যাণ হয়।"

সুবীরেশ বাবুদের ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। 
শ্রীময়ী ও শুভম দের বাড়ির সমস্ত ব্যাপার শুনে ঘরে দরজা দিয়ে কাঁদতে লাগলো।
পাশের বাড়ির বৌদি এসে শ্রীময়ীর পাশে বসে বললো,
" ঠাকুরঝি তুমি কিছু চিন্তা করো না তো,
শুভম বিজ্ঞানের শিক্ষক ও এসব তুচ্ছ ব্যাপারের জন্য নিশ্চয় বিয়ে ভেঙে যেতে দেবে না। আর আজ কালকের দিনে এসব কেউ মানে নাকি?"

বৌদির কথায় শ্রীময়ীর হৃদয়ের ধু ধু মরুতে যেন মরুদ্যান দেখা দিলো। নিজেও মনকে সান্ত্বনা দিলো "এখনকার দিনে এসব মানে নাকি"
ওই দিন সারা রাত ফোনের অপেক্ষায় জ্যোৎস্নার আলোয় আধ ফোটা রজনীগন্ধা গুলোর দিকে তাকিয়ে কেটে গেল।

দুদিন পরে ১৪ই অঘ্রায়ণ দুপুর বেলা জম দূতের মতো ঘটক এসে সেই অপ্রত্যাশিত খবরটিই শ্রীময়ীর বাবাকে শুনিয়ে গেল, " ওনারা বিয়ে টা ভেঙে দিলেন। তবে চিন্তা করবেন না আমার কাছে আরো ভালো ভালো ছেলের খোঁজ আছে। আমি মা শ্রীময়ীর জন্য ওর থেকে অনেক ভালো ছেলে এনে দেবো, আপনি একদম চিন্তা করবেন না।"

শ্রীময়ী ঘরে গিয়ে কপাট লাগিয়ে দিলো, সেদিন আর সে কিছুই মুখে তুললো না। মনে মনে ভাবতে লাগলো আজ ১৪ ই অঘ্রায়ণ এই সময় হয়তো আমাদের শুভ দৃষ্টি হতো, তার পরে মালা বদল।
তার জীবনে আসা বসন্তের সব ফুল যেন হঠাৎ আসা এক দমকা হাওয়ায় ঝরে পড়লো।মনের ওই বহ্নি শিখা গুলো যাতে সে অগ্নিস্নান করে শুদ্ধ হতো এখন সেগুলো যেন তার বুকের ভিতরে কলঙ্কের ছাই হয়ে গেল। গভীর যন্ত্রনা ও কষ্টে চোখের জল ও যেন ওই ছাই গুলোকে ধুয়ে ফেলতে পারলো না। 
কিন্তু ওই রজনীগন্ধার ফুল গুলো সময় মতোই ফুটেছে আজ। জ্যোৎস্না রাতের যেই রজনীগন্ধা গুলোর দিকে তাকিয়ে সে মধু চন্দ্রিমার আবেগে  ভেসে যেত আজ সেগুলোই যেন দুঃখের বান ডেকে আনছে।


১৫ই অঘ্রায়ণ সকালে শ্রীময়ী দরজা খুলছে না দেখে মা জানলার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে দেখে সিলিং ফ্যান এর সাথে তার দেহটি ঝুলছে। হাতে একখানা চিঠি
তাতে লেখা রয়েছে...
" বাবা আমার মরদেহ বাহক গাড়িটাকে আমার বাগানের রজনীগন্ধা দিয়েই সাজিও।"
কিছুক্ষন পরে পুলিশ এসে শ্রীময়ীর লাশ নিয়ে গেল। শ্রীময়ীর বাবা মা চোখের জলে মেয়েকে বিদায় দিলেন।
সারা দিন  হসপিটাল এর লাশকাটা ঘরে শ্রীময়ীর কাল রাত্রি কাটলো। 

তার পর দিন ১৬ ই অঘ্রায়ণ ভরা পূর্ণিমা,সন্ধ্যায় রথতলা মহা শ্মশানে শ্রীময়ীর নিজের হাতে লাগানো রজনীগন্ধা দিয়ে তার জীবনের শেষ বাসর সাজানো হলো। চিতার আগুনে মাঙ্গলিক শ্রীময়ীর দেহ পুড়লো আর তার আবেগ গুলো যেন কালো ধোঁয়া হয়ে পূর্ণিমার আলো কে নিভিয়ে দিয়ে গেল।


✍️রামমনি হালদার,
হেমতাবাদ, উত্তর দিনাজপুর


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ