Subscribe Us

সময়ের অনুভূতি (নিরঞ্জন পাল)

লেখাটি বার পড়া হয়েছে

--'সময়ের অনুভূতি'--

-নিরঞ্জন পাল


দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেল|বাড়ির বাইরে করোনা পরিস্থিতির পর এই প্রথম বাইরে বেড়োনো,পরিবেশটাও একেবারে নতুন মনে হচ্ছে|প্রকৃতি যেন অন্য ভাবে সেজেছে|যাইহোক বাড়ি থেকে বেড়িয়ে,টোটো করে বাসট্যান্ডে পৌছোলাম|কিন্তু যার বেশি ঘুরতে যাওয়ার সখ,যে ঘুরতে যাবে বলে বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল,তার কোনো পাত্তা নেই|বেশ কয়েক মিনিট ধরে দাড়িয়ে রয়েছি,একটু ভালো করে খেয়াল করলাম,গাড়িদের আনাগোনা নেই বললেই চলে|কিন্তু টোটোর উৎপাত আগের মতোই,কিছুক্ষণ পর পর এক দুটো বাসগাড়ি চলছে|দাড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় আধঘন্টা হয়ে এলো,এর মধ্যেই চোখে পড়ল মহারাজ মানে তাপস আমার বন্ধু টোটোতে আসছে|এসে আমার সামনে নামল|নামতেই একটা বাস যেতে দেখা গেল,যার উপরে নাম লেখা আছে বালুরঘাট,যেটাতে আমরা দুজনে যাব|গাড়িটা দেখতেই কোন মতো টোটোর টাকা মিটিয়ে গাড়িতে উঠেই তিন সিট ওয়ালা একটা সিট সামনেই ছিল,যেটাতে জানালার ধারে এক ভদ্রলোক বসে ছিল|আমি আর তাপস পাশের দুটো সিট নিয়ে সেখানেই বসে পড়লাম|আমাদের সিটের আগের সিটটাই ছিল ড্রাইভারের সিট| হঠাৎই তার দিকে চোখ গেল|বয়স পঞ্চান্ন-ছাপান্ন হবে|গায়ের রং শ্যামবর্ণ,মুখটা বেশ ভরাটে,দুই গাল ভরে রয়েছে দাড়ি|দাড়ির মাঝে মাঝে অসংখ্য ক্ষতোর চিহ্ন|দুচোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে|দেখতে বেশ কঠন,ভাবলেশহীন|

যেতে যেতে গাড়িটা হঠাৎই থামালো|তাঁর সামনে অজস্র দেব-দেবীর মূর্তির ছবি|সেগুলোকে প্রণাম করে,বেশ তৃপ্তির সাথে জল নিবারন করে পুনরায় সে আবার গাড়ি ছাড়ল|

বললাম জল খাওয়ার আগে ঠাকুর প্রণাম করলেন কেন,ড্রাইভার কাকু?
-- প্রণাম আমি সবসময়ই করি,যেকোন কাজ এবং খাওয়ার আগে|
-- আপনি প্রতিনয়ত ঠাকুর প্রণাম করেন?
-- চেষ্টা করি|
-- কিন্তু,আমি খেয়াল করলাম আপনাকে ,গাড়ি         চালাতে চালাতে বেশ কিছু বিড়ি শেষ করলেন|সেটা কী ছাড়া যায় না?
-- ছাড়ার চেষ্টা করছি|
-- না মানে,শুনেছি মানুষ একবার নেশায় পড়লে নাকি সেটা ছাড়তে পার না|
-- কথাটি ভুল নয়,আবার ভুল|
-- কেন?
-- আমি আরো অনেক নেশা করতাম|সেগুলো ঠাকুরের ইচ্ছায় বাদ দিয়ে দিয়েছি|এখন শুধু বিড়ির নেশাটাই করি,এটাও আশা করি বাদ হয়ে যাবে|
-- আপনি পারবেন তো?
-- ঠাকুর জানে| আর নিজে চাইলে সব করা যায়|
-- আচ্ছা আপনি কী খুব চিন্তা করেন?আপনি কী খুব কঠিন মনের মানুষ?
--- দেখে কী মনে হয় তোমার?
-- মনে হয়, খুব কঠিন মনের মানুষ|
-- আজ পর্যন্ত চোখে কোন দিন জলটুকু আনি নাই|গাড়ি চালাচ্ছি চৌদ্দ বছর বয়স থেকে,বাবা মারা যাওয়ার পর|সেই সময় থেকেই সংসারের হাল ধরেছি|গাড়ি চালাতে চালাতে বহু মানুষের মরণও কম দেখি নাই,কত অ্যাকসিডেন্ট,কত ধরনের মৃত্যু যে চোখে পড়েছে বলে শেষ করা যাবে না|তাই এসব দেখতে দেখতে বুক আজ পাথর হয়েছে,আর মন কঠিন|

এইভাবে ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতে ব্যক্তি জীবনের গল্পটা বেশ জমে উঠেছিল|আর বন্ধু তাপস সে নিজের মতো গভীর নিদ্রায় মগ্ন|যদিও গাড়িতে উঠলে আমারও ঘুম পাই|কিন্তু,ড্রাইভারের সাথে গল্পে,কথাবার্তায় ঘুমটা যেন ড্রাইভারের কঠিন হৃদয়ের শব্দগুলোই কেড়ে নিয়েছিল|এইভাবে ড্রাইভারের সাথে কথা বলকে বলতে যখন কালিয়াগঞ্জ ছাড়িয়ে বুনিয়াদ পুর বাসট্যান্ডেবাসটি থামালো,তখন বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার নামল এবং কয়েরজন গাড়িতে উঠল|ড্রাইভারের এক্কেবার সামনের সিটে বসে থাকা মহিলাটিও নেমে গেল,সে সিট থেকে উঠতেই আমি সেখানে গিয়ে বসি|

-- তার পাশে গিয়ে বসতেই সে বলল|
--পান খাবে?
--  যদিও আমি মাঝে মাঝে পান খায়,কিন্তু সেই সময় খেতে ইচ্ছে করছিল না|ড্রাইভার কাকু বলায় তার 
কথা ফেলতে পারলাম না|সে পান খাবার প্রস্তাব দিতেই আমি সমর্থন করলাম এবং পান নিয়ে মুখে দিলাম|

এরপর কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপ|তার দেখলাম ড্রাইভার কাকু হঠাৎই একটা গান চালাল|গান শুনতে শুনতে কখন যে দুটো চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে বুঝতে পারিনি|

ড্রাইভার কাকু হঠাৎই বলল দেশটা শেষ|কথাটি আমার কানে মৃদু স্বরে আসে|আমি আচমকায় তন্দ্রা ভেঙে উঠে বললাম---
-- কী বললেন কাকু?
--দেশটা শেষ করে দিল করোনা ভাইরাস|বাবাকে হারিয়েছি ছোট থাকতেই,মা ছিল সেও আজ নেই|করোনা আমার মাকেও কেড়ে নিল,কত প্রিয়জনকেই না হারিয়েছি|সেসব কথা মনে পড়লে বুকটা কেপে ওঠে|
-- আমি চুপ|
এরমধ্যেই গাড়িটা বংশীহাড়ি এসে পৌছায়|বন্ধু তাপস বলেছে আর কতক্ষণ রে ?
-- এই চলে এসেছি|আর পনেরো মিনিট|

এই দিকে সূর্যও অস্ত যাচ্ছে,ড্রাইভার কাকুর মলিন চোখ দুটোতে যে ঘুম আনাগোনা করছে|

-- কাকু আপনি কখন বাড়ি যাবেন?
-- রাত্রি দশটায়|
-- শরীরে ক্লান্তি আসে না আপনার?
-- আসতো প্রথম প্রথম,এখন আসলেও বুঝতে পারি না|

ইতিমধ্যেই চারিদিক আবছা হয়ে এলো|রাস্তার ল্যম্পপোস্ট গুলোও জ্বলে উঠল|সেই আলো ড্রাইভার কাকুর মুখে পড়ে যেন চক চক করছে|
পিছন থেকে খালাশি বলে উঠল কালীতলা কালীতলা|বন্ধু তাপস ব্যাগ নিয়ে ঝটপট উঠে বলে ওই নামবি না চলে এসেছি তো!

আমি ড্রাইভার কাকুর সাথে নীরব মনে শেষ দুটো কথা বলে দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম|

                                 -----------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ